রক্তদানের আগে যা জানা প্রয়োজন
রক্তদান একটি মহৎ কাজ যা অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। সফল ও নিরাপদ রক্তদানের জন্য কিছু প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। আপনার শরীর যাতে রক্তদানের পর দ্রুত পুনরুদ্ধার হয় এবং আপনি সুস্থ থাকেন সেজন্য নিম্নলিখিত প্রস্তুতি নিতে পারেন।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: সাধারণ রক্তদানে মাত্র ৪৫০ মিলি (১ ইউনিট) রক্ত নেওয়া হয়, যা আপনার মোট রক্তের পরিমাণের ১০% এরও কম। আপনার শরীর এই পরিমাণ রক্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় তৈরি করে ফেলে।
রক্তদানের যোগ্যতা
রক্তদানের আগে নিম্নলিখিত মূল যোগ্যতাগুলো বিবেচনা করুন:
- বয়স: ১৮-৬০ বছর (কিছু ক্ষেত্রে ১৭ বছর বয়সে চিকিৎসকের অনুমতিতে রক্তদান করা যায়)
- ওজন: ন্যূনতম ৫০ কেজি
- হিমোগ্লোবিন মাত্রা: পুরুষদের জন্য ১৩ g/dL এবং মহিলাদের জন্য ১২.৫ g/dL এর বেশি
- রক্তচাপ: ১৮০/১০০ mmHg এর নিচে এবং ১০০/৬০ mmHg এর উপরে
- নাড়ির গতি: মিনিটে ৬০-১০০ বার
- সময় ব্যবধান: পূর্ববর্তী রক্তদান থেকে অন্তত ৩ মাস অতিক্রান্ত হওয়া
রক্তদানের ১-২ দিন আগে
খাদ্যাভ্যাস
করণীয়
- প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খান (যেমন: পালং শাক, মাংস, কলিজা, ডিম, মটরশুটি)
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান (কমলা, লেবু, আমলকী)
- পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করুন
বর্জনীয়
- অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার (ফাস্টফুড, ভাজাপোড়া) এড়িয়ে চলুন
- অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকুন
- ধূমপান কমিয়ে আনুন বা বন্ধ করুন
ঘুম ও বিশ্রাম
- রক্তদানের আগের রাতে ভালো ঘুম নিন (কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা)
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন
- শান্ত ও স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা বজায় রাখুন
রক্তদানের দিন
খাদ্য ও পানীয়
- ভরপেট ব্রেকফাস্ট করুন: রক্তদানের ২ ঘণ্টা আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খান
- প্রচুর পানি পান করুন: রক্তদানের আগে কমপক্ষে ২-৩ গ্লাস পানি পান করুন
- ক্যাফেইন সীমিত রাখুন: অতিরিক্ত চা, কফি এড়িয়ে চলুন
অবশ্যই মনে রাখবেন: খালি পেটে কখনও রক্তদান করবেন না! এতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
পোশাক
- আরামদায়ক, ঢিলেঢালা পোশাক পরুন
- হাতার উপরের দিকে সহজে গুটানো যায় এমন জামা/শার্ট পরা ভালো
- অতিরিক্ত গরম বা গুমোট পোশাক এড়িয়ে চলুন
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও জিনিসপত্র
- সরকারি পরিচয়পত্র (জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স)
- ব্লাডলি অ্যাপ/পরিচয়পত্র (যদি থাকে)
- পূর্ববর্তী রক্তদানের রেকর্ড (যদি থাকে)
- যে কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা ওষুধ সেবন করে থাকলে তার তালিকা
রক্তদান প্রক্রিয়া
রক্তদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা থাকলে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারবেন:
- নিবন্ধন: রক্তদান কেন্দ্রে গিয়ে ফর্ম পূরণ করে নিবন্ধন করুন
- প্রাথমিক পরীক্ষা: আপনার রক্তচাপ, তাপমাত্রা, নাড়ির গতি এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হবে
- চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎকার: আপনার স্বাস্থ্যগত ইতিহাস সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা হবে
- রক্তদান: রক্তদান প্রক্রিয়া সাধারণত ৮-১০ মিনিট সময় নেয়
- বিশ্রাম: রক্তদানের পর ১০-১৫ মিনিট বিশ্রাম নিন
- পুনরুজ্জীবিতকরণ: জুস, ফল, বিস্কুট বা হালকা নাস্তা গ্রহণ করুন
রক্তদানের আগে যে অবস্থায় রক্তদান করা উচিত নয়
নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে রক্তদান স্থগিত রাখা উচিত:
- জ্বর বা সর্দি-কাশি থাকলে
- বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণরত অবস্থায়
- গত ৩ মাসের মধ্যে শরীরে টিকা নেওয়া থাকলে (চিকিৎসকের পরামর্শ নিন)
- গত ৬ মাসের মধ্যে শরীরে ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করা থাকলে
- গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মহিলা
- রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া থাকলে
- উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে
- গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাঁত তোলা বা বড় ধরনের শারীরিক আঘাত পেয়ে থাকলে
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যদি আপনি নিয়মিত কোনো ঔষধ সেবন করেন, তাহলে রক্তদানের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর
রক্তদানের সময় কি ব্যথা হয়?
সাধারণত খুব সামান্য ব্যথা হয়, যা সুঁই ঢোকানোর সময় হাতে একটি ছোট চিমটির মতো অনুভূত হয়। এরপর আর কোনো ব্যথা থাকে না।
রক্তদানে কতক্ষণ সময় লাগে?
পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগে, যার মধ্যে ফর্ম পূরণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রক্তদান (৮-১০ মিনিট) এবং বিশ্রাম অন্তর্ভুক্ত।
কত ঘন ঘন রক্তদান করা যায়?
পুরো রক্ত দানের ক্ষেত্রে প্রতি ৩ মাস অন্তর রক্তদান করা যায়। তবে প্লাটিলেট ডোনেশনের ক্ষেত্রে ২ সপ্তাহ পর পরও দেওয়া যেতে পারে।
রক্তদানের পর কি দুর্বল লাগবে?
সাধারণত হালকা দুর্বলতা অনুভব হতে পারে, তবে ভালো খাবার, বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত পানি পানের মাধ্যমে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা যায়।
রক্তদান পরবর্তী যত্ন
রক্তদানের পর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলুন:
- রক্তদানের পর ১০-১৫ মিনিট বিশ্রাম নিন
- প্রচুর পরিমাণে পানি এবং ফলের জুস পান করুন (পরবর্তী ২৪-৪৮ ঘণ্টায়)
- ২৪ ঘণ্টা ভারী শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন
- অ্যালকোহল ও ধূমপান এড়িয়ে চলুন
- যদি রক্তদানের জায়গায় ব্যান্ডেজ থাকে, তবে তা কমপক্ষে ৪-৫ ঘণ্টা রাখুন
- যদি মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা অনুভব করেন, তাহলে বসে পড়ুন বা শুয়ে পড়ুন এবং পা উঁচু করে রাখুন
জরুরি অবস্থা: যদি রক্তদানের পর নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা নিন:
- দীর্ঘক্ষণ মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- রক্তদানের স্থানে অবিরাম রক্তক্ষরণ
- উচ্চ জ্বর বা ইনফেকশনের লক্ষণ
- রক্তদানের স্থানে অস্বাভাবিক ব্যথা বা ফোলাভাব
নিয়মিত রক্তদানের উপকারিতা
নিয়মিত রক্তদান শুধু অন্যের জীবন বাঁচায় না, এটি আপনার নিজের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী:
- হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: নিয়মিত রক্তদানে রক্তে আয়রনের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
- ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়: গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত রক্তদাতাদের কিছু ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম
- কোষের পুনর্জন্ম উৎসাহিত করে: রক্তদানের পর নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- ক্যালোরি পোড়ায়: এক ইউনিট রক্তদানে প্রায় ৬৫০ ক্যালোরি পোড়ে
- বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা: প্রতিবার রক্তদানের আগে আপনার রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন এবং হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা হয়
"একজন রক্তদাতা তিনজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারেন - আপনার রক্তদান কারও জীবনে দিতে পারে নতুন আশা।"
ব্লাডলি'র মাধ্যমে রক্তদান করুন
ব্লাডলি'র মাধ্যমে রক্তদানের জন্য নিবন্ধিত হয়ে যোগ দিন আমাদের স্বেচ্ছা রক্তদাতা নেটওয়ার্কে। আমাদের প্লাটফর্মে নিবন্ধন করলে আপনি পাবেন:
- নিয়মিত রক্তদানের স্মরণিকা ও নোটিফিকেশন
- আপনার রক্তদানের ইতিহাস ও সার্টিফিকেট
- রক্তদাতা পয়েন্ট ও রিওয়ার্ড
- আপনার এলাকায় রক্তের প্রয়োজন সম্পর্কে অবিলম্বে জানানো
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ
মনে রাখবেন - আপনার রক্তদান কারও জীবনের জন্য অমূল্য। আসুন সবাই মিলে রক্তদানের মাধ্যমে জীবন বাঁচাই।